News:

                   শিবপুর সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়

১৯১৬-১৯১৭ সালের কথা। তখনও নরসিংদী জেলার হতে গোনা কয়েকটি মাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এগুলোর মধ্যে স্যার কে.জি গুপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়, নরসিংদী কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয়, হাতিরদিয়া সাদত আলী উচ্চ বিদ্যালয়, লাখপুর শিমুলিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, পোড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং আদিয়াবাদ উচ্চ বিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য। কিন্তু শিবপুরে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। এখানকার ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া করতে হলে ১২-১৬ মাইল পথ অতিক্রম করে দূরবর্তী কোন স্কুলে পড়তে হত। এই পরিস্থিতিতে সমসাময়িক কালে শিবপুর এলাকার মধ্যে পাঁচপাইকার রাজেন্দ্র হালদার ছিলেন সবচেয়ে শিক্ষিত ও জমিদার শ্রেণীর লোক। তৎকালে চাকরির সুবাদে তিনি কলকাতা থাকতেন। একবার ছুটিতে রাজেন্দ্র হালদার বাড়ি আসলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসুক সবাই বিদ্যালয়ের জন্য জমি চাইলে তিনি ন্যূনতম সংকোচ না করে অকাতরে জমি দান করে দিলেন। এবার জমির ব্যবস্থা হয়ে গেলে শুরু হলো অর্থ সংগ্রহ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাঁশ ও অগ্রহায়ন মাসের ধান দিয়ে মহাধুমধামে শিবপুর স্কুলের ভিত্তি প্রস্তর শুরু হয়েছিল। কেবল লাইব্রেরী কক্ষটি ছিল চৌচালা টিনের ঘর। আর উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পশ্চিম মুখী মাটির ঘরের দক্ষিণের শেষ কক্ষটি ছিল প্রধান শিক্ষকের কক্ষ। প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে বিদ্যালয়ের প্রথম সভাপতি ছিলেন তৎকালীন এস.ডি.ও। প্রথম সহ-সভাপতি ছিলেন চাঁন্দেরটেক নিবাসী মরহুম আশরাফ আলী খান সকলের সম্মতিক্রমে লাকুশী গ্রামের উচ্চ শিক্ষিত ‍সুরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী কে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।

শিবপুর সরকারি পাইলট মডেল ‍উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে যারা জড়িত ছিলেন তারা হলেন-পাঁচপাইকার জমিদার স্বর্গীয় রায় বাহাদুর দেবেন্দ্র মজুমদার, পাঁচপাইকা গ্রামের স্বর্গীয় রাজেন্দ্র হালদার, চক্রধা ইউনিয়নের চাঁন্দেরটেক নিবাসী মরহুম আশরাফ আলী খান, চক্রধা’র সুভট্ট বাবু, ধানুয়া মিয়া বাড়ির মরহুম খান সাহেব, খড়িয়ার মরহুম নইমউদ্দিন সরকার প্রমূখ মহতী প্রাণের প্রচেষ্টায় আর অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শিবপুর হাই স্কুল। পরবর্তীকালে মোসলেহ উদ্দিন খান, ইউনুছ আলী মিয়া, মাহতাব উদ্দিন খান বিদ্যালয়ের কর্মকান্ডের সাথে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯১৮ সালের ১০ জানুয়ারি শিবপুর সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ দ্যিালয়-এর উদ্বোধন করা হয়। ঐ দিন থেকেই বিদ্যালয়ের ক্লাশ শুরু হয়েছিল। শিবপুর সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেবল নরসিংদী জেলার মধ্যেই নয় বরং; সারা দেশের মধ্যে একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিবপুর থানা কম্পেলেক্স থেকে ২০০ গজ পশ্চিমে শিবপুর সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় এর অবস্থান।

এর উত্তরে উপজেলা খাদ্য গুদাম, পশ্চিমে ঢাকা-মনোহরদী মহাসড়ক (কলেজ গেইট বাস স্ট্যান্ড), দক্ষিণে কলেজ গেইট-শিবপুর বাজার প্রধান সড়ক এবং পূর্বে শিবপুর মডেল সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় অবস্থিত। শিবপুর সরকারি শহীদ আসাদ কলেজ সংলগ্ন বিদ্যালয়ের খেলার মাঠসহ বর্তমানে শিবপুর সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৪.২৫ একর।

শতবর্ষ পূর্বে গড়ে উঠা এ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো সমসাময়িক কালে খুব একটা আড়ম্বরপূর্ণ ছিল না। মাটির দেয়াল আর টিনের চালা নিয়ে ১৯১৮ সালের ১ জানুয়ারি এইচ. ই. (হাই ইংলিশ) স্কুল নাম নিয়ে বর্তমান শিবপুর সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের পদযাত্রা শুরু হয়েছিল। লাকুশী গ্রামের সুরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ছিলেন শিবপুর হই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। প্রতিষ্ঠাকালীন স্কুল ঘরটি ছিল মাটির দেয়াল বেষ্টিত দক্ষিণ ও পশ্চিম মুখী টিনশেড ঘর। সে সময়ে স্কুলের কোন সীমানা প্রাচীর ছিল না। পূর্ব-পশ্চিম আর দক্ষিণ দিকে মেহেদী গাছের বেড়া ছিল। দক্ষিণ  দিকে স্কুলের মাঝামাঝি বরাবর স্কুল গেইট ছিল। তৎসংলগ্ন একটি কাঠাল গাছের নিচে পানি পান করার জন্য একটি টিউবওয়েল ছিল। স্কুলের চারদিক সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকায় স্কুল ঘরে প্রচুর আলো বাতাসের ব্যবস্থা ছিল। আর স্কুলের পশ্চিম উত্তর কোণে ছিল শৌঁচাগার। বিদ্যালয়ের পশ্চিম প্রান্তে কয়েকটি জাম গাছের নিচে মাটিতে পাটির চট বিছিয়ে অস্থায়ীভাবে নামাজের স্থান করা হয়েছিল। কেননা শিবপুর বাজার মসজিদ ব্যতীত আশে পাশে কোন মসাজিদ ছিল না। এর ঠিক উত্তর পার্শ্বে ছিল স্কুল হোস্টেলের জন্য নির্ধারিত রান্না ও খাবার ঘর। তখন স্কুল থেকে থানা পর্যন্ত কোন বাড়ী-ঘর ছিল না। মাঠ আর মাঠ, মনে হত যেন বিরাট এক প্রান্তর।

সে সময়ে শিবপুর হাই স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল কো-এডুকেশনাল সিস্টেম। অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে একসাথে পড়াশোনা করত। চক্রধা’র অনেক হিন্দু মেয়ে শিবপুর পাইলট স্কুলে পড়াশোনা করত। কিন্তু কোন মুসলমান মেয়েদের উপস্থিতি ছিল না। কারণ তৎকালীন মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের বাড়ির বাইরে গিয়ে স্কুলে পড়াশুনা করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। ১৯২২ সালে নারায়ণগঞ্জ মহাকুমায় শিবপুর হাই স্কুল থেকে মেট্রিক (এস.এস.সি) পরীক্ষায় প্রথম ব্যাচ পাঠানো হয়। ঐ বছর শিবপুর হাই স্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল মোট ৯ জন। মৌলভী আবু তাহের ও বেনজির আহমেদ (কবি বেনজির আহমেদ) সহ ৬ জন প্রথম বিভাগে এবং ৩ জন দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন । এভাবে প্রথম ব্যাচের গৌরবোজ্জল ফলাফলের মধ্য দিয়ে শিবপুর হাই স্কুলের শুভ যাত্রা সূচিত হয়েছিল।

১৯১৮ সালের ০১ জানুয়ারি, জনাব সুরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী’র দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিবপুর হাই স্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সমসায়িক কালে এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিবপুর থানা তথা নরসিংদী জেলার ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করার পথ সুগম হয়েছিল। তখনকার দিনে দূর-দূরান্ত থেকে দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে এসে পড়াশুনা করতে হত। কাল পরাম্পরায় প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক শ্রী সুরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী অন্যত্র চলে গেলে (জুলাই-১৯১৯) সাবেক কুমিল্লা জেলার (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়ীয়া) বাঞ্ছারামপুর থানার শ্রী অনুকূল চন্দ্র ধর শিবপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মৌলভী আবু তাহের (বিএবিটি)। শৌর্য-বীর্য আর নবজাগরণের প্রতীক রূপে তিনি বিদ্যালয়ের হাল ধরেন।

১৯৫৪ সালে বন্যার পানিতে শিবপুর হাই স্কুল একাকায় ক্রমাগত বন্যার পানিতে স্কুল ঘরের মাটির দেয়াল টইটুম্বুর। পানির স্পর্শে মাটির দেয়াল খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। কোনো এক গভীর রাতে বিকট আওয়াজ তুলে স্কুল ঘরের মটির দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে যা পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকেও ভয়ঙ্করভাবে শোনা গিয়েছিল। সে সময় বিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশে কোনো দেয়াল ছিল না। শুধু ছিল ঘন ঘন করে লাগানো জিকা গাছ (কাফিলা গাছ)। বন্যার পানিতে মাটির দেয়াল ভেঙ্গে গেলে স্কুল ভবন নতুন করে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন মাটির দেয়ালের জায়গায় মূলি বাঁশের বেড়া তৈরী হলো। ফলে ১৯৫৮ সালের দিকে মুলি বাঁশের বেড়া ঘেরা ইংরেজি ‘এ’ আকৃতির রূপ নেয়। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ইংরেজী ‘এল’ আকৃতির টিনের ঘরই ছিল শিবপুর হাই স্কুলের অবকাঠামো। কালের বিবর্তনে মাটির দেয়াল ঘেরা টিনের চালা বিশিষ্ট স্কুল ভবনটি ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির রূপ নেয়। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ইংরেজি ‘এল’ আকারের একদিকের অংশ ছিল কোঠা ঘর। আর উত্তর অংশে অবস্থিত পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দক্ষিণ মুখী ভবনটি ছিল তর্জার বা মুলির বেড়ার। শ্রেণী কক্ষের সিলিং ছিল চাটাই এর তৈরী। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর ক্লাশ গুলো একটি ক্রমসজ্জায় বিন্যস্ত ছিল যা ক্রমান্বয়ে যেন ধীরে ধীরে রাস্তার সাথে মিশে যাচ্ছিল।

এই ‘এল’ এর কোনা দিয়ে ভাঙ্গা ছিল যেখান দিয়ে উত্তরের সৈয়দের গাঁও-এর  ছাত্ররা মেঠো পথে এসে ভাঙ্গা অংশ দিয়ে সরাসরি স্কুল চত্বরে ঢুকে যেত। ১৯৬২ সালে তদানিন্তন আইয়ূব সরকারের শাসনামালে বরাদ্দকৃত ৬০,০০০/- (ষাট হাজার) টাকা অনুদান স্কুল ভবনের পশ্চিম অংশের দুটি কক্ষের পাকা করার কাজ শুরু হয়েছিল। শিবপুর হাই স্কুলে ইটের দালান উঠবে এই সংবাদ ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে দারুন উদ্দীপনা ও কৌতুহলের জন্ম দিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের পাগলা ঘাট থেকে পুরাতন সাব-রেজিষ্ট্রী অফিসের ঘাটে নৌকা এসে ভিড়ত। আর সেখান থেকে শিবপুর হাই স্কুল পর্যন্ত ছাত্ররা সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে শিক্ষকদের সহযোগিতা ও দিক নির্দেশনার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত আগ্রহ ভরে বদল করে ইট নিয়ে আসত। এভাবে ছাত্র-শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে পাকা নিয়ে শিবপুর হই স্কুলের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শিবপুর হাই স্কুলে কো-এডুকেশনাল সিস্টেম (সহ শিক্ষা) চালু ছিল। মূলত আঃ হাই সরকারের বাবা (শিবপুর হাই স্কুলের তৎকালীন হেড মৌলভী) মৌলভী আব্দুল আজিজ সাহেব এবং মৌলভী আবু তাহের সাহেবের মেয়েদ্বয়ের আলাদা বিদ্যালয়ে পড়ানোর প্রবণতা থেকে ১৯৬৪ সালে ওনাদেরই প্রচেষ্টায় শিবপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নগঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব আবুল হাসিম। যেহেতু বালিকাদের জন্য আলাদা বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল; সুতরাং ১৯৬৪ সাল থেকে শিবপুর হাই স্কুল কেবল বালক বিদ্যালয় হিসেবেই পরিচিতি পেতে থাকে। ১৯৭১ সাল ছিল শিবপুর হাই স্কুলের জন্য গৌরবের বছর। কেননা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এই স্কুলের সাহসী অংশগ্রহণ এবং সার্বিক অবদান নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধের সময় এই স্কুলের ছাত্র জনাব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শিবপুর হাই স্কুলে ২৭শে মার্চ, নরসিংদী জেলার প্রথম মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। সে সময়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত মরহুম মজনু মৃধা ও তৎকালীন আনসার কমান্ডার জনাব সানাউল্লাহ এলাকার যুবক ও ছাত্রদেরকে মুক্তিযোদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে শিবপুর হাই স্কুল মাঠে ট্রেনিং দেয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পাক বাহিনী শিবপুরে চলে আসলে ট্রেনিং ক্যাম্পটি বিলসরন গ্রামের মহি’র টেক-এ স্থানান্তর করা হয়েছিল। মহান মু্ক্তিযোদ্ধে এ বিদ্যালয়ের ছাত্র ফজলু, আমজাদ, মানিক, জলিল, সাদেক এবং মিয়ার উদ্দিন সহ নাম না জানা অনেকে শহীদ হন। এমন কি যুদ্ধে বিজয় লাভের পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে অস্ত্র জমা দানের নির্দেশ দিলে এ বিদ্যালয় মাঠেই সমস্ত অস্ত্র জমা করা হয়েছিল।

            ১৯৭২ সালে দত্তেরগাঁও মধ্যপাড়ার অতুল চন্দ্র কর শিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কে প্রায় ২০ হাজার টাকার জমি দান করেন। মৃত্যুর পূর্বে অতুল চন্দ্র কর তাঁর সকল সম্পত্তি মৌলভী আবু তাহের সাহেবকে দিয়ে যান যেখানে দত্তেরগাঁও মৌজার প্রায় ২০ কানী সম্পত্তি ছিল। মৌলভী আবু তাহের সাহেব অতুল কর-এর নামে শিবপুর হাই স্কুলে এই জমি দান করে দেন। পরবর্তীতে মৌলভী সাহেব এই সম্পত্তি বিভিন্ন লোকের নিকট বিক্রি করে স্কুল ভবন নির্মাণ কাজে ব্যায় করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, অতুল চন্দ্র কর ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিবপুর ও রায়পুরা থানার ঋণ সালিশী বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।

            জনাব মৌলভী আবু তাহের সাহেব দীর্ঘ ২৫ বছর অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখ অবসর গ্রহণ করেন। সৎ, নির্ভীক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিমূর্তী রূপে তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট শ্রদ্ধাভাজন ও অনুসরণীয় ব্যক্তি ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের পক্ষে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭২ সালে জনাব মৌলভী আবু তাহের সাহেব অবসর গ্রহণ করলে একই বছর জনাব ফজলুর রব শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময়ে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে আমূল পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধিদ হয়েছিল। পূর্বের ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির ভবনের জায়গায় নতুন করে ইংরেজি ‘ই’ আকৃতির ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। পূর্ব, উত্তর এবং পশ্চিম অংশে স্থাপিত ভবনগুলো যথাক্রমে পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে মুখ করা ছিল। আর উত্তর অংশে স্থাপিত পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দক্ষিণ মুখি ভবনের ঠিক মাঝ বরাবর ছিল প্রধান শিক্ষকের কক্ষ । এই প্রধান শিক্ষকের কক্ষ বরাবর বারান্দার অংশ মূল বারান্দা থেকে বর্ধিত করার ফলে বিদ্যালয়টি একটি সুন্দর ইংরেজি বর্ণ ‘ই’ আকৃতি ধারন করেছিল। তাছাড়া বিদ্যালয়ের দক্ষিণ সাড়িতে নারিকেল গাছ বেষ্ঠিত ও সুবিশাল মাঠ সমৃদ্ধ ত্রিমুখী দালান ভবনে বিদ্যালয়টিকে খুব চমৎকার লাগত। ইংরেজি ‘ই’ আকৃতির পাকা দালান ঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শিবপুর থানাধীন চাঁন্দের টেক গ্রামের জনাব মোঃ শামসুল হক মোল্লা। মৌলভী আবু তাহের সাহেবের অনুরূধক্রমে মোল্লা সাহেব এই স্কুলের পাকা দালান ঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন (উল্লেখ্য; ১৯৫৯ সালে তিনি কুমিল্লা জেলার মুন্সেফ ছিলেন)। নবগঠিত ইংরেজি বর্ণ ‘ই’ আকৃতি বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। পূর্ব পার্শ্বে পুকুর ছিল। আর বিদ্যালয়ের মূল ভবনের পশ্চিম পাশে মসজিদ ছিল। তখনও কোনো সীমনা প্রাচীর ছিল না।

            ১৯৮০ সালে সারা দেশে পাইলট প্রকল্প চালু হলে শিবপুর হাই স্কুল পাইলট প্রকল্পের আওতায় চলে আসে। ফলে বহু প্রাচীন “শিবপুর হাই স্কুল” এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “শিবপুর পাইলট হাই স্কুল”। পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২ লক্ষ টাকা সরকারি অনুমোদনের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের পূর্ব অংশে স্থাপিত উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ভবণের দো’তলার কাজ সম্পন্ন করেন। দীর্ঘ ১৩ বছর কৃতিত্বের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ১ মার্চ, ১৯৮৫ সালে জনাব ফজলুর রব অবসর গ্রহণ করেন।

            জনাব ফজলুর রব অবসর গ্রহণ করার পর একই বছর জনাব নাদিরুজ্জামান শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১০ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর ৫ এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে জনাব নাদিরুজ্জামান অবসর গ্রহণ করেন। জনাব নাদিরুজ্জামান অবসর গ্রহণ করলে একই বছর জনাব আবুল হাসিম শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অল্প কাল প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ১৫ মার্চ, ১৯৯৬ সালে জনাব আবুল হাসিম অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে জনাব আবুল হাসিম অবসর গ্রহণ করলে ১৯৯৬ সালে জনাব সহিদ উল্লাহ ভূঁইয়া শিবপুর পাইলট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ববার গ্রহণ করেন। জনাব সহিদ উল্লাহ ভূঁইয়া স্যারের সময়ে ১৯৯৮ সালে সরকারি অর্থায়নে এল.জি.ই.ডি এর আওতায় বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয় যা এখনো বর্তমান।

১৯৯৭ সালের গোড়ার দিকে পূর্ব পাশের পুকুর ভরাট করে কারিগরি শাখার নতুন ভবন তৈরি করা হয়। ১৯৯৯ সালে প্রাথমিক বিদালয়টি শিবপুর পাইলট হাই স্কুলের পূর্ব-উত্তর কোনে বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তর করা হয়। ২৫ এপ্রিল, ২০০১ সালে দীর্ঘ ৫ বছর কৃতিত্বের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর জনাব সহিদ উল্লাহ ভূঁইয়া অবসর গ্রহণ করেন।

            জনাব সহিদ উল্লাহ ভূঁইয়া অবসর গ্রহণ করলে ২০০১ সালের ২৬শে মে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জনাব ফজলুর রহমান (ফটিক মাস্টার)। ইংরেজি ‘ই’ আকৃতির বিদ্যালয়ের মূল ভবনের পশ্চিম অংশে অবস্থিত উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পূর্বমুখী ভবণটুকু ভেঙ্গে এবং পূর্বে যে মসজিদটি ছিল তা ভেঙ্গে বিদ্যালয়ের পশ্চিম-উত্তর কোনে ২০০৩-২০০৪ অর্থ বছরে শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের অর্থানুকুলে পূর্বমূখী একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। অল্প সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ২০০৩ সালের ৩০ শে আগস্ট জনাব ফজলুর রহমান অবসর গ্রহণ করেন।

জনাব ফজলুর রহমান অবসর গ্রহণ করলে ০১ সেপ্টেম্বর, ২০০৩ সালে জনাব তোফাদ্দেক হোসেনর খান (মানিক স্যার) শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অল্প সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ২০০৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

            জনাব তোছাদ্দেক হোসেন খান অবসর গ্রহণ করলে ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ সালে জনাব তোফাজ্জেল হোসেন (তোফাজ্জেল মাস্টার) শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব জামাল আহমেদ চৌধুরী’র ১০ লক্ষ টাকা অনুদানে বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পূর্বমুখী একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। নবগঠিত ভবনের নিচতলার শেষ দক্ষিণের কক্ষটি নামাজের কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার ঠিক দক্ষিণে সীমানা প্রাচীর ঘেষে রয়েছে পানি পান করার টিউবওয়েল। তাছাড়া প্রধান শিক্ষকের কক্ষ বরাবর বিদ্যালয়ের দক্ষিণের সীমানা প্রাচীর ঘেষে ছাত্রীদের জন্য পানি পান করার আরেকটি টিউবওয়েল রয়েছে। ২০০৭ সালে বিদ্যালয়টি মডেল প্রকল্পের আওতাভুক্ত হলে পূর্বের “শিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়” বর্তমান “শিবপুর পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়” নামে আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রায় ৫ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ সালে জনাব তোফাজ্জল হোসেন অবসর গ্রহণ করেন।

            জনাব তোফাজ্জেল হোসেন অবসর গ্রহণ করলে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জনাব মোরশিদুজ্জামান খান। মাত্র ৬ মাস ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর একই বছর জুন মাসের ২৯ তারিখে জনাব মোরশিদুজ্জামান খান অবসর গ্রহণ করেন। জনাব মোরশিদুজ্জামান খান অবসর গ্রহণ করার পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন জনাব মহব্বত হোসেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০১১ সালে মডেল স্কীমের শর্ত হিসেবে পূণরায় কো-এডুকেশনাল সিস্টেম চালু করা হয়। ৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ সালে জনাব মহব্বত হোসেন অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে জনাব মোঃ ইব্রাহীম সরকার, জনাব সালাহ উদ্দিন, জনাব মোঃ আমির হোসেন (পূর্ণ মেয়াদে), জনাব মোঃ বিল্লাল হোসাইন ধারাবাহিকভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

            ২০১৪ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে উত্তর-পশ্চিম অংশে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দক্ষিণমূখী সুরম্য তিনতলা ভবন নির্মিত হয়। নতুন ভবনের প্রত্যেকটি কক্ষেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের উপযোগী করে তৈরি। প্রতিটি কক্ষে প্রজেক্টর, সাউন্ড সিস্টেম, ল্যাপটপ এবং মাউথ স্পীচ রয়েছে। বিদ্যালয়টিতে মোট ১৯টি ল্যাপটপ ও ১১টি ডেস্কটপ, ১ টি ৫৬ইঞ্চি এলইডি টিভি, ২ টি সার্ভার পিসি সহ ২টি আধুনিক মান সম্মত কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে। বিদ্যালয়ে স্কুল অফ ফিউচার চালু আছে। স্কুল অফ ফিউচারের আওতায় ৬ টি ক্লাস রুমে স্মার্ট বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।ছাত্র-শিক্ষক,কর্মচারিদের হাজিরার জন্য ডিজিটাল মেশিন বসানো হয়েছে এবং সবাইকে ডিজিটাল আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছে।

            শিবপুর পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়-এর বর্তমান প্রধান শিক্ষক জনাব নূর উদ্দিন মোঃ আলমগীর অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ একজন শিক্ষক। ৩০ আগস্ট, ২০১৫ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতা জীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি তাঁর সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তারই স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তিনি জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের মর্যাদা লাভ এবং জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৬ এ শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন। ২০ জানুয়ারী, ২০২২ সালে বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ হয়।এছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও ফলাফলে সাফল্য অর্জনের জন্য সনদ ও এক লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ২৯টি শ্রেণি কক্ষ, ১টি বিজ্ঞানাগার, ১টি গ্রন্থাগার ও ২টি কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় বিদ্যালয়টি প্রতিযোগিতার শীর্ষে অবস্থান করছে। বিগত বছর গুলোতে মেধা তালিকায় প্রশংসনীয় অবস্থানে অবস্থান করছে। একদিকে নারিকেল গাছের সাড়ি, অপরদিকে বিস্তৃত সবুজ মাঠ মিলে প্রাকৃতিক শ্যামল ছায়ায় অবস্থিত শিবপুর পাইলট মডেল হাই স্কুলে মোট ৩৬ জন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী প্রায় ১৫০০ ছাত্র-ছাত্রীকে নিরলস পাঠ দানের মাধ্যমে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ের সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।